দুর্নীতি প্রতিরোধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার বিকাশে গণশুনানি
গণশুনানি হচ্ছে সরকারি পরিষেবার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার একটি কার্যকর কৌশল। দুর্নীতি দমন কমিশন মূলত তৃণমূল পর্যায়েই এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে তৃণমূলের সাধারণ মানুষ তাদের অভিযোগ জানাতে পারছে। গণশুনানি অনেকটা ত্রি-পক্ষীয় বৈঠক। এখানে অভিযোগকারী সেবাগ্রহীতা নাগরিকগণ, সেবাপ্রদানকারী সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত থাকেন। সকলের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে তাৎক্ষণিকভাবে অধিকাংশ অভিযোগ/সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। আবার যেসব সমস্যার সমাধান তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না, সেসব সমস্যা ফলোআপ গণশুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, ফলোআপ গণশুনানি বাস্তবায়ন করায় দুদকের গণশুনানি বেশ কার্যকর এবং সুশাসন বিকাশে জনপ্রিয় একটি কৌশল হিসেবে কাজ করছে।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে গণশুনানির যাত্রা শুরু করে দুদক। গণশুনানিতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং সমর্থন কমিশনকে গণশুনানি পরিচালনায় উৎসাহিত করে। গণশুনানি কমিশনের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালনা করা হচ্ছে। গণশুনানিতে উত্থাপিত বেশিরভাগ অভিযোগই থাকে পরিষেবা বিষয়ক। আইনগতভাবে সুযোগ থাকলে কিছু অভিযোগ ঐদিনই নিষ্পত্তির জন্য বলা হয়। অবশিষ্ট অভিযোগসমূহ সময়াবদ্ধভাবে নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হয় এবং তা কমিশন থেকে ফলোআপ করা হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো, নাগরিকের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদ (UNCAC) এর ১৩ অনুচ্ছেদে দুর্নীতি প্রতিরোধে সমাজের (সুশীল সমাজ, এনজিও, গণমাধ্যম ইত্যাদি) অংশগ্রহণ এবং তথ্য প্রাপ্তি ও রিপোর্টিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, ২০১২-এ নাগরিককে দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। চতুর্থত, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালে সরকারি সেবা প্রদানে গণশুনানি একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
গণশুনানির উদ্দেশ্য
গণশুনানির তাত্ত্বিক কাঠামো
বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০৪-এ বর্ণিত সামাজিক দায়বদ্ধতা কাঠামোকে গণশুনানির তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ কাঠামো অনুযায়ী সেবা প্রদানের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার জন্য প্রয়োজন- (১) নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিকের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, (২) নাগরিকগণ কর্তৃক সেবা প্রদানকারীদের কার্যক্রম পরিবীক্ষণ, নাগরিকদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নীতিনির্ধারক কর্তৃক সেবা প্রদানকারীদের জন্য প্রণোদনা কাঠামো প্রবর্তন। গণশুনানির মাধ্যমে সেবা প্রদানকারীকে নাগরিকের কাছে প্রত্যক্ষভাবে দায়বদ্ধ করার বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
গণশুনানির আইনি কাঠামো
গণশুনানি কার্যক্রম পরিচালনা
সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে হয়রানি, অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কমিশন গণশুনানিকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি হচ্ছে সেবাগ্রহীতা জনগণ ও সরকারি সেবা প্রদানকারী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাই সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে হয়রানি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রিতা দূর করা অতীব জরুরি। প্রতিটি গণশুনানিতে কমিশনের চেয়ারম্যান অথবা কমিশনার উপস্থিত থেকে গণশুনানি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। কমিশন ইতোমধ্যে গণশুনানি পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। প্রতিটি গণশুনানির ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ যেমন সরকারি সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন নন, তেমনি সরকারি সেবা প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণ নানাভাবে সঠিক সময়ে সেবা প্রদান না করে নাগরিকদের বঞ্চিত করে থাকেন। কোন ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীগণ অনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সেবা প্রত্যাশীদের হয়রানিও করে থাকেন।
এসকল গণশুনানির মাধ্যমে অনেক সমস্যার যেমন তাৎক্ষণিক সমাধান করা হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎস শনাক্তকরণ, সেগুলোর প্রকৃতি ও ব্যাপকতা চিহ্নিত করে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরসমূহের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কমিশনকে নিরলসভাবে সহযোগিতা করছেন। ২০১৬ সালে দুদক গণশুনানি পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে। বর্তমানে এই নীতিমালার ভিত্তিতেই গণশুনানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
গণশুনানির প্রত্যাশিত ফলাফল